গুপ্ত সাম্রাজ্য[Gupta Dynasty]

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে কুষাণরা ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজারা কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু কুষাণ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে ভারত আবার খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে মগধকে কেন্দ্র করে আর্যাবর্তের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে এক রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে গুপ্ত রাজবংশ।

গুপ্ত রাজারা সম্ভবত বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং কুষাণ রাজাদের সামন্ত হিসাবে উত্তর প্রদেশে শাসন করতেন।

শ্রীগুপ্ত:

  • গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা (founder of Gupta dynasty)ছিলেন শ্রীগুপ্ত
  • তিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
  • তিনি মহারাজ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

ঘটোৎকচ:

  • পরবর্তী শাসক তার পুত্র ঘটোৎকচ শক্তিশালী রাজা ছিলেন।
  • তিনিও মহারাজ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত [Chandragupta I] (৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে - ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত):

  • প্রথম চন্দ্রগুপ্তকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় কারণ তিনি স্বাধীন সামন্ত রাজা ছিলেন।
  • প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ৩২০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তাব্দ চালু করেন।
  • তিনি লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন ।
  • ভারতীয় শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • তাঁর রাজ্য উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ, বিহার, এমনকি বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।

সমুদ্রগুপ্ত [Samudragupta] (৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে - ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) :

  • প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি গুপ্ত রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ।
  • সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর পুত্র। কুমারদেবী অধিকাংশ সময় লিচ্ছবিতে অবস্থান করায় সমুদ্রগুপ্তের জীবনে মামাবাড়ির প্রভাব পড়ে এবং নিজেকে লিচ্ছবি দৌহিত্র নামে পরিচিত করেন।
  • সমুদ্রগুপ্ত সম্বন্ধে জানা যায় সভাকবি হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি ও মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত এরাণ লিপি থেকে।
  • সমুদ্রগুপ্তের উপাধি - একরাট, পরক্রমাঙ্ক, সর্বরাজোচ্ছেত্তা, অশ্বমেধ-পরাক্রম, অপ্রতিরথ ও কবিরাজ
  • সমুদ্রগুপ্ত প্রথমে উত্তর ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং নয়টি রাজ্য জয় করেন। আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতের এই নয়টি রাজ্যের রাজারা হলেন অচ্যুত , নাগসেন , মতিল , নাগদত্ত , চন্দ্রবর্মন , গণপতিনাগ , নন্দীন , রুদ্রদেব ও বলবর্মন ।
  • উত্তর ভারতের পর তিনি দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন । দক্ষিণ ভারতের যেসমস্ত রাজাকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছিলেন , তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকজন হলেন মহেন্দ্র ( কোশল ) ; বিষ্ণুগােপ ( কাঞি ) ; ব্যাঘ্ররাজ ( মহাকান্তা ) ; ধনঞ্জয় ( কুন্তলাপুর ) ; হস্তীবর্মন ( বেঙ্গি ) ; স্বামীদত্ত ( কোত্তর ) ; নীলরাজ ( অভমুক্তা ) ; উগ্রসেন ( পলাক্কা ) প্রমুখ । তবে দক্ষিণ ভারতের রাজাদের পরাজিত করলেও সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি । আনুগত্যের বিনিময়ে তাদের নিজ নিজ রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’তে এই নীতিকে গ্রহণ পরিমােক্ষ বলা হয়েছে ।
  • দক্ষিণ ভারত বিজয় সম্পূর্ণ করে সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেন । এই উপলক্ষ্যে তিনি বিশেষ একধরনের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন । এই মুদ্রার একদিকে ছিল যজ্ঞের ঘােড়ার প্রতিকৃতি ও অপরদিকে ছিল রাজমহিষী দত্তাদেবীর প্রতিকৃতি । সমুদ্রগুপ্তের সামরিক প্রতিভার প্রশংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক স্মিথ তাঁকে ভারতীয় নেপােলিয়ন ( Indian Napoleon ) বলে অভিহিত করেছেন ।
  • ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়েও সমুদ্রগুপ্ত পরধর্মমতসহিষ্ণু ছিলেন। সিংহল-রাজ মেঘবর্ণ-কে সমুদ্রগুপ্ত বুদ্ধ গয়ায় মঠ নির্মাণের অনুমতি দেন ও ভূমিদান করেন।
  • পাটলিপুত্র ছিল সমুদ্রগুপ্তের রাজধানী। সমুদ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুবন্ধু।
  • সমুদ্রগুপ্ত কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের উপাধি ছিল কবিরাজ বা শ্রেষ্ট কবি। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় অঙ্কিত বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গীতানুরাগের কথা জানা যায়। বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত হরিসেন সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন এবং বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুবন্ধু তার পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন।
  • সমুদ্রগুপ্তের দুই ছেলে- বড় ছেলে- রামগুপ্ত, ছোট ছেলে- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত

রামগুপ্ত

  • “দেবীচন্দ্রগুপ্তম্‌” নাটক থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন ।
  • রামগুপ্ত বিবাহ করেন দক্ষিনের রাজকন্যা ধ্রুবদেবীকে যিনি শক রাজা রুদ্রসেনের বাগদত্তা ছিলেন। রুদ্রসেন রামগুপ্তকে পরাজিত করে ধ্রুবদেবীকে হরন করে নিয়ে যান।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রুদ্রসেনকে হত্যা করে রানির মর্যাদা রক্ষা করেন । পরে রামগুপ্তকে হত্যা করে ও  ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করে সিংহাসন দখল করেন ।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত [Chandragupta II Vikramaditya](৩৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে - ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) :

  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পিতার দিগ্বিজয়ী নীতি নুসরণ করেন । সাম্রাজ্যর প্রসারের জন্যে তিনি তিনটি নীতি অনুসরণ করেন- বৈবাহিক সম্পর্ক, সন্ধি ও যুদ্ধজয়।
  • প্রথমে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মধ্য ভারতের শক্তিশালী নাগ-বংশীয় রাজকন্যা কুবের নাগ-কে বিবাহ করেন।
  • তিনি বাকাটক রাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিবাহ দিয়ে দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম অঞ্চলে নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেন । বিবাহের পাঁচ বছর পর রুদ্রসেনের মৃত্যু হলে প্রভাবতী নিজ পুত্রের অবিভাবক রূপে রাজত্ব করেন । ফলে বাকাটক রাজ্য কার্যত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কুন্তল বা কর্ণাটকের কদম্ব বংশের কাকুৎসুবর্মণের রাজকন্যার সঙ্গে নিজ পুত্র প্রথম কুমারগুপ্তের বিবাহ দেন।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক রাজা তৃতীয় রুদ্রসেন বা রুদ্রসিংহকে যুদ্ধে পরাজিত করে শক রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং 'শকারি বা শকদের শত্রু' উপাধি ধারণ করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তার রাজধানী উজ্জয়িনী নিয়ে যান।
  • চন্দ্রগুপ্ত বিভিন্ন মুদ্রায় বিক্রমাদিত্য উপাধি ব্যবহার করেছেন ।
  • তিনি পরম ভগবত উপাধি ধারণ করেছিলেন।
  • চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন ।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দিনার নামক স্বর্নমুদ্রা চালু করেন।
  • তিনি এক রৌপমুদ্রা প্রচলন করেন।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন এবং তার উপাধি ছিল পরম ভাগবত। ধর্মবিশ্বাসে বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরধর্মমতসহিষ্ণু ছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যে প্রচুর বৌদ্ধ মঠ দেখেছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সেনাপতি আম্রকর্দব বৌদ্ধ ছিলেন এবং মন্ত্রী বীরসেন ছিলেন শৈব।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নরেন্দ্রচন্দ্র, সিংহচন্দ্র, নরেন্দ্রসিংহ, সিংহবিক্রম, দেবরাজ, দেবশ্রী নামে পরিচিত ছিলেন।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা নবরত্ন অর্থাৎ নয়জন রত্ন অলঙ্কৃত করতেন ।
    • কালিদাস( কবি এবং নাট্যকার )
    • বরাহমিহির( জ্যোতির্বিজ্ঞানী )
    • বররুচি ( সংস্কৃত পণ্ডিত )
    • ধ্বন্বন্তরি (চিকিৎসক )
    • শঙ্কু( আর্কিটেক্ট )
    • বেতাল ভট্ট ( ম্যাজিশিয়ান )
    • ঘটকর্পর
    • ক্ষপণক( জ্যোতিষী )
    • অমর সিংহ (কবি এবং সংস্কৃত অভিধানলেখক )

প্রথম কুমারগুপ্ত [Kumaragupta I] (৪১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে - ৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) :

  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র কুমারগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন ।
  • তিনি অশ্বমেধের যজ্ঞ করেছিলেন এবং ‘মহেন্দ্রাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কুমার গুপ্তের আমলে প্রতিষ্ঠা হয়।
  • কার্ত্তিক পূজার প্রচলন করেন।
  • প্রথম কুমার গুপ্ত আমেদাবাদ, বলভি,জুনাগড়,মরভি,সাতারা বেরার তার সাম্রাজ্যের ভুক্ত করেন।
  • ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘সাধুসুলভ রাজা’ বলেছেন।

স্কন্দগুপ্ত :

  • গুপ্তযুগের শেষ শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন স্কন্দগুপ্ত [Skandagupta] । তিনি ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।
  • হুন আক্রমণ প্রতিহত করার জান্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে “ভারতের রক্ষাকারী” বলে অভিহিত করেছেন ।
  • জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায় তিনি সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদ সংস্কার করেন ।
  • তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন।

গুপ্ত যুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ-

  • গুপ্ত বংশের শেষ শাসক — বিষ্ণুগুপ্ত।
  • গুপ্তযুগকে ভারত ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ বলে অভিহিত করা হয়।
  • গুপ্তরাজাগণ বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন.
  • বৌদ্ধদর্শনের উজ্জ্বলতম রত্ন অসঙ্গ ও বসুবন্ধু নামক ভ্রাতৃদ্বয় গুপ্তযুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন।
  • এ যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি ভবভূতি, বৈয়াকরণ ভর্তৃহরি, দার্শনিক কুমারিল ভট্ট, গৌড়পাদ প্রমুখ বিশ্ববন্দিত মনীষীগণ।
  • পাটলিপুত্রের প্রসিদ্ধ গণিত শাস্ত্রবিদ আর্যভট্ট সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি নির্ণয় করে প্রচার করেন। আর্যভট্ট আবিষ্কার করেন – শূন্যের ব্যবহার, ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলির স্থানীয় মান, পাই এর মান ,বীজগণিত।
  • মালবের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা ও পঞ্চসিদ্ধান্ত নামক জ্যোতিষ গ্রন্থসমূহ বিজ্ঞান জগতের অমূল্য সম্পদ।
  • চিকিৎসক রূপে ধন্বন্তরির যশ ভারতে আজও অনন্য।
  • ব্রহ্মগুপ্ত মাধ্যাকর্ষণ বিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলেন।
  • পশু চিকিৎসার জন্য রসায়নশাস্ত্রে নাগার্জুনের মতাে প্রতিভার সাক্ষাৎ গুপ্ত যুগেই মিলেছিল।
  • গুপ্ত যুগের বিখ্যাত বন্দর ছিল তাম্রলিপ্ত।
  • গুপ্ত যুগের স্বর্ণ মুদ্রা দিনার নামে পরিচিত। এবং রৌপ্য মুদ্রা রুপিয়াকা নামে পরিচিত।
  • গুপ্ত যুগের সরকারী ভাষা ছিল সংস্কৃত।
  • গুপ্ত যুগে রচিত উল্লেখযোগ্য রচনা গুলি হল-
    • কবি কালিদাসের লেখা গ্রন্থ গুলি – অভিজ্ঞান শকুন্তলম, মেঘদূতম্, রঘুবংশম্ , বিক্রমবংশীয় , মালবিকাগ্নিমিত্রম , কুমারসম্ভবম , ঋতুসংহার।
    • শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম
    • বিশাখদত্তের লেখা ‘মুদ্রারাক্ষস’এবং ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম’
    • আর্য ভট্ট – সূর্যসিদ্ধান্ত , আর্যভট্টম ।
    • অমরসিংহের লেখা অমরকোষ নামক বিখ্যাত অভিধান
    • বিষ্ণু শর্মা রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’
    • ভারবির লেখা ‘কিরাতার্জুনীয়ম’, অবন্তী সুন্দরী কথা
    • ভবভূতি রচনা করেছিলেন উত্তর রামচরিত নাটক ।
    • দন্ডিনের ‘দশকুমারচরিত’
    • বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’
    • নারায়ণ শর্মা রচিত ‘হিতোপদেশ’
    • কামন্দক লেখা নীতিসার গুপ্তযুগের অর্থশাস্ত্র নামে পরিচিত।
    • হিন্দুদের দুটি শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এ যুগে নতুন করে সংকলিত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে বলে অনেকেই অনুমান করেন। ভাগবতগীতা এই সময় লেখা হয়েছিল। ভাগবতগীতায় ১৮ টি অধ্যায় এবং ৭০০ টি সংস্কৃত শ্লোক আছে। পরাশর, মনুস্মৃতি ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্র গুপ্তযুগে পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করে। পুরাণ গ্রন্থসমূহ এ সময় পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়।
  • উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য
    • অজন্তা গুহা চিত্র গুপ্ত রাজাদের নিদর্শন।
    • সারনাথে প্রাপ্ত ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ, মথুরায় প্রাপ্ত দণ্ডায়মান বুদ্ধ, সুলতানগঞ্জে প্রাপ্ত বুদ্ধের তাম্রমূর্তি বৌদ্ধ ভাস্কর্য গুপ্তযুগের শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
    • উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দেওগড়ের দশাবতার প্রস্তরনির্মিত মন্দির, তিগোয়ার বিষ্ণু মন্দির, কুবীরের পার্বত্য মন্দির প্রভৃতি গুপ্তযুগের স্থাপত্য শিল্পের চরম উৎকর্ষের সাক্ষ্য বহন করছে।
    • বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়্‌

গুপ্ত শাসনব্যবস্থা :
  • রাজা ও রাজতন্ত্রঃ গুপ্ত শাসব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সকলের শীর্ষে। সমরবিভাগ, বিচারবিভাগ পরিচালনা, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও অন্যান্য গুরত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রভুতি ব্যাপারে রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। রাজাকে সাহায্য করতেন মন্ত্রী, যুবরাজ ও কর্মচারী। যুবরাজ সামরিক ও বেসামরিক বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করত।
  • আমলাতন্ত্রঃ মন্ত্রীরা রাজাকে পরামর্শ দিতেন। মন্ত্রীপদ ছিল বংশানুক্রমিক। মন্ত্রীরা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী। অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন - মহাবলাধিকৃত (প্রধান সেনাপতি), মহাদণ্ডনায়ক (সেনাপতি), মহাপ্রতিহার (প্রধান দ্বাররক্ষক), সন্ধিবিগ্রহিক (বৈদেশিক বিষয়ক, যুদ্ধ ও শান্তির ভারপ্রাপ্ত), অক্ষপটলাধিকৃত (সরকারি দলিলপত্র রচনা ও রক্ষার ভারপ্রাপ্ত)।
  • প্রাদেশিক শাসনঃশাসব্যবস্থাকে পরিচালনার জন্য সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। এই যুগে প্রদেশগুলিকে বলা হত ভুক্তি বা দেশ যেমনঃ অহিছত্র ভুক্তি, শ্রাবস্তী ভুক্তি, মুকুলিদেশ। সাধারণত উপরিক বা উপরিক মহারাজা বা অনেক সময় মহারাজ-পুত্র-দেবভট্টারক উপাধিধারী রাজপুত্রগণ ভুক্তির শাসনকর্তা নিযুক্ত হতেন। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত কুমারমাত্য ও আয়ুক্তরা
  • জেলা শাসনঃ প্রদেশগুলি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। বিষয় শাসনের দায়িত্ব ছিল বিষয়পতির উপর। বিষয়পতিদের সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক জেলায় পুরোগ থাকতো। জেলার শাসকগণ সাধারণত প্রদেশপাল বা গভর্নর-কর্তৃক নিযুক্ত হতেন, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্রাট জেলাশাসকদের নিয়ােগ করতেন। জেলাশাসককে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করবার জন্য নানা কর্মচারী ছিলেন। শৌলিক ছিলেন কর আদায়কারী, গৌল্মিক ছিলেন দুর্গ ও বনসম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভূমিরাজস্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ধ্রুবাধিকরণিক। খাজাঞ্চিখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ভাণ্ডাগারাধিকৃত। বলভটক ছিলেন হিসাব পরীক্ষক। প্রত্যেক জেলায় মহাফেজখানা থাকত এবং তার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন মহাক্ষপটলিক। এছাড়া জেলাতে লেখক, করণিক প্রভৃতি কর্মচারী ছিলেন।
  • গ্রাম শাসনঃগ্রাম ছিল শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। গ্রামের শাসনভার ছিল গ্রামিক নামক কর্মচারীর উপর ন্যস্ত। গ্রামের প্রধান বা মােড়লকে বলা হত মহত্তর বা ভােজক। ইনি গ্রাম শাসনে গ্রামিককে সাহায্য করতেন। এছাড়া গ্রামের বয়ােবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ ও মােড়লদের নিয়ে গঠিত পঞ্চমণ্ডলী বা গ্রামজনপদ নামে একটি সভা শাসন পরিচালনা বিষয়ে গ্রামিককে পরামর্শ দিত।
  • পৌর শাসনঃজনবহুল শহরগুলিতে অধিকরণ বা নিগম সভা পৌর শাসন পরিচালনা করত। নগরশ্রেষ্ঠা, সার্থবহ, প্রথম কুলিক, প্রথম কায়স্থ প্রভৃতি ব্যক্তিদের নিয়ে নিগম সভা গঠিত হত। নগর শাসনের প্রধানকে বলা হত পুরপাল বা নগররক্ষক। পুরপাল উপরিক নামে একশ্রেণির কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত তিনি পুরপালদের কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। অবস্থিক নামক কর্মচারীরা নগরের ধর্মশালা গুলি তত্ত্বাবধান করতেন।
  • আইন ও বিচার ব্যবস্থা: বিচার বিভাগে রাজাই সর্বেসর্বা, তিনি নিজে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন এবং এ কাজে তাকে সাহায্য করতেন অন্যান্য বিচারক, মন্ত্রী ও ব্রাহ্মণরা। শহরাঞ্চলে বিচারককে সাহায্য করতেন নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবহ ও অন্যান্য ব্যক্তিরা। গ্রামে পঞ্চায়েত বিচারকার্য পরিচালনা করত। এই যুগের আইনগ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি ও কাত্যায়ন।
  • রাজস্ব ব্যবস্থা: গুপ্তযুগে রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভুমি। উৎপন্ন ফসলের একযষ্ঠাংশ বা এক চতুর্থাংশ ছিল ভূমিকর। একে বলা হত ভাগ। কর্মচারীদের বেতনের উপর কর ধার্য করা হত। একে বলা হত ভােগ। এছাড়া বাণিজ্য ও শিল্পদ্রব্য থেকে শুল্ক, খনি, লবণ, জঙ্গল, ফেরিঘাট, বাজার প্রভৃতি থেকে কর আদায় করা হত। বৈদেশিক আক্রমণকালে মল্লকর নামে একপ্রকার কর আরােপ করা হত। সরকারি কাজে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করতে হত। একে বলা হত বিষ্টি।